যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন স্থগিতে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্প ও কর্মীদের ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন স্থগিতের কারণে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, যা কর্মীদের চাকরি এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে। এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের জনগণের জীবনযাত্রা ও সামাজিক উন্নয়নকে আরও কঠিন করে তুলছে।

 0
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন স্থগিতে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্প ও কর্মীদের ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন স্থগিতে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্প ও কর্মীদের ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন স্থগিতে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্প ও কর্মীদের ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা

গত ২০ জানুয়ারি ট্রাম্প প্রশাসনের এক নির্বাহী আদেশের ফলে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থায়নে চালু বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের হাজার হাজার উন্নয়নকর্মী অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন। যদিও আদেশটির ফলে ৯০ দিনের পর্যালোচনা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, তবুও অনেক কর্মী ইতোমধ্যেই চাকরি হারিয়েছেন এবং প্রকল্পগুলোর কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। ইউএসএআইডির (USAID) ওয়েবসাইটও বন্ধ হয়ে গেছে।

প্রকল্প কর্মীদের অস্থির জীবন

প্রকল্প কর্মীদের অফিসে না যেতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে, কর্মীরা অফিসে উপস্থিত হলেও কোনো কাজ করছেন না। ঢাকায় ইউএসএআইডি-অর্থায়িত একটি প্রকল্পের মধ্যম পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, "আমরা অফিসে আসি, সামাজিক মাধ্যমে সময় কাটাই কিংবা নতুন কোনো দক্ষতা শেখার চেষ্টা করি। এই অনিশ্চয়তা হতাশাজনক।" আরেকজন প্রকল্প কর্মকর্তা বলেন, "আমাদের বাসা থেকে কাজ (ওয়ার্ক ফ্রম হোম) করতে বলা হয়েছে, কিন্তু আমাদের কোনো কাজ নেই। আমরা জানি না ৯০ দিন পর আমাদের আর চাকরি থাকবে কিনা।"

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট

এই অর্থনৈতিক সংকট এমন সময়ে এসেছে যখন বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক ঋণের উচ্চ পরিশোধ এবং বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির মুখোমুখি। শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশ। এছাড়াও, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ফসলের ক্ষতি হয়েছে এবং বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২.৬৬ মিলিয়ন মানুষ কর্মসংস্থান খুঁজছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৬ শতাংশ বেশি। মুদ্রাস্ফীতি এখনও ১০ শতাংশের কাছাকাছি, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর আরও চাপ বাড়িয়েছে।

উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা

উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন কমানোর ফলে বাংলাদেশের উন্নয়ন খাতে তহবিল সংকোচন আরও গভীর হবে। বাংলাদেশের উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ডেভেলপমেন্ট এজেন্সিজের (এডিএবি) পরিচালক এ কে এম জসিম উদ্দিন সতর্ক করেছেন যে, "যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন কমানোর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে।"গত বছর যুক্তরাষ্ট্র ৯৬টি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ৪৫০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছিল। কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন যে, ট্রাম্প বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে আসার ফলে জেন্ডার, এলজিবিটিকিউ অধিকার, টিকাদান, স্বাস্থ্য ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক প্রকল্পগুলোতে অর্থায়ন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। 

সহায়তা স্থগিতের প্রভাব

বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নের প্রকল্পগুলোতে আনুমানিক ২০ হাজার পেশাদার কাজ করেন। দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা স্থগিত হলে বিক্রেতা, ডিলার এবং কয়েক মিলিয়ন সুবিধাভোগীর ওপর এর প্রভাব পড়বে।ইতোমধ্যে আইসিডিডিআর,বি এক হাজারেরও বেশি কর্মীকে ছাঁটাই করেছে, যাদের বেশিরভাগই ইউএসএআইডির অর্থায়নে পরিচালিত টিউবারকুলোসিস প্রকল্পের জন্য কাজ করতেন। এছাড়াও, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের (এইউডব্লিউ) আফগান শিক্ষার্থীদের অর্থায়ন স্থগিত করেছে। এর ফলে তারা তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া নিয়ে ঝুঁকির মুখে পড়েছেন।এইউডব্লিউ-এর উপাচার্য রুবানা হক বলেছেন, "এখানে প্রায় ৫৫০ জন আফগান শিক্ষার্থী ভর্তি আছেন, আরও ৩৩০ জনের আসার কথা। আমরা সত্যিই বড় সমস্যায় পড়েছি।" বিশ্ববিদ্যালয়টি আফগান শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে বিকল্প অর্থায়নের জন্য আবেদন করেছে।

উন্নয়ন খাতের সঙ্কোচন

এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর মতে, এনজিওগুলোর জন্য সাহায্য গত কয়েক বছর ধরে কমছে। ২০১৯ সালে বৈদেশিক সহায়তা ছিল ৯৪৫ মিলিয়ন ডলার, যা ২০২৩ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ৭৪১ মিলিয়ন ডলারে। এনজিও কর্মকর্তারা বলেন, উন্নয়ন খাতের বেশিরভাগ চাকরি চুক্তিভিত্তিক ও প্রকল্পভিত্তিক এবং পরিষেবা সুবিধা সীমিত।"এই খাতটি ইতোমধ্যেই সঙ্কুচিত হয়ে আসছিল। যদি যুক্তরাষ্ট্র তহবিল কমিয়ে দেয়, তাহলে এর প্রভাব মারাত্মক হবে," বলছিলেন একজন এনজিও কর্মকর্তা। বাংলাদেশে এনজিও অর্থায়নের ৫০ শতাংশের বেশি আসে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছ থেকে।

ভবিষ্যতের পথচিহ্ন

বাংলাদেশের উন্নয়ন খাত এবং সহায়তাভোগীদের জন্য এটি একটি চ্যালেঞ্জিং সময়। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন স্থগিতের প্রভাব কেবল কর্মীদের নয়, বরং দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন খাতে গভীর প্রভাব ফেলবে। বিকল্প অর্থায়নের সন্ধান এবং স্থানীয় সম্পদের ব্যবহার বাড়ানো ছাড়া এই সংকট মোকাবেলা করা কঠিন হবে।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow